Sarika Banerjee, VIII A (2019-20)
‘দাদা তাড়াতাড়ি দিন , দেরি হয়ে গেছে আমার’। সব্জির বস্তাটা হাতে নিয়ে পাঁই পাঁই করে তনয়া ছুটে চলল নিজের কোয়ার্টারের দিকে।
তনয়া , বাইশ বছরের একটি মেয়ে বাংলায় পি.এইচ.ডি. করার জন্য গিয়ে ছিল শান্তিনিকেতনে। তনয়া খুব গুণী মেয়ে , পড়াশোনায় তো ভালোই , তার ওপর নাচ , গান , আঁকা সবেতেই তার ঝোঁক। কিন্তু তার সখ , গল্প লেখা। দারুণ গল্প লেখার হাত তার। তনয়ার স্বভাবও প্রশংসার বিষয়। সবার প্রিয় সে। কিন্তু নির্জন জায়গায় থাকতে বেশি ভালো লাগে তনয়ার। তাই যে কোয়ার্টারে থাকে সে , সেই কোয়ার্টারে তেমন কেউ নেই। শুধু নিচের তলায় আছে তার প্রিয় বন্ধু রবিন। আর তাছাড়া কেউ নেই। সেদিন রবিন গিয়েছিল তার এক বন্ধুর বাড়ি। তাই বলতে গেলে ভালোই নিস্তব্ধতা ছিল।
তনয়া গিয়েছিল সব্জি কিনতে , খুব রাত হয়ে গেল ফিরতে। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে ন’টা। কোয়ার্টারের গার্ড , হরি কাকা , তিনিও আটটার মধ্যে বাড়ি ফিরে যান। বলেন , তাঁর রাতে কোয়ার্টারে একা পাহারা দিতে ভয় লাগে। বাইরে , অন্য কোয়ার্টারগুলো একটু দূরে দূরে। রাতে মাটির গন্ধ আর দূরে অন্যান্য কোয়ার্টারগুলোর মিটমিটে আলো তনয়াকে লেখার নতুন বিষয় মনে করিয়ে দেয় যেন। যাই হোক , নিচের দিকে অন্ধকার। দু-একটা নিওন বাতি জ্বলছে , সেগুলো সারা রাতই জ্বলে। তার ওপর রবিন নেই , আরোই নিস্তব্ধ চারিপাশ। তনয়ার একটু ভয় ভয় করছিল ঠিকই , কারণ ওদের কোয়ার্টারে ভূত দেখা যায় বলে সবার বিশ্বাস। তনয়া আর রবিনের ভূতে ভয় নেই, অত্যন্ত সাহসী ওরা , তাই এই কোয়ার্টারই ওদের পছন্দ। তনয়া গুটি গুটি পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠল। নিচে দুটো আর উপরে তিনটে ঘর। সেই তিনটি ঘরের মধ্যে প্রথম ঘরটি ওর। সুন্দর সাজানো , দুটি খাট। তালা খুলে ভিতরে ঢুকল তনয়া। জানলা দিয়ে দূরে অন্যান্য কোয়ার্টারের আলো ঝলমল করতে দেখা যাচ্ছে। যদিও কেউই বাইরে নেই।
সব্জিগুলো ফ্রিজে রেখে , গতকালের কেনা স্যান্ডউইচ খেয়ে গল্প লিখতে বসল তনয়া। নির্জন, নিস্তব্ধ , গল্প লেখার সঠিক সময়। লিখতেও ইচ্ছে করছে তার। তাই সময় নষ্ট না করে সে লিখতে বসে গেল। দিব্যি লিখছিল , কিন্তু কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল , তা বুঝতেই পারল না তনয়া।
খট্ , খট্ , খট্ , খট্ । আচমকা ঘুম ভেঙে গেল তনয়ার। ‘জানলায় কি টোকা মারছে ?’ , নিজের মনেই বলে উঠল সে। শব্দ ক্রমশঃ বাড়তে থাকল । তারপর হঠাৎ থেমে গেল । তনয়া ভাবল বুঝি মনের ভুল, গল্প লিখতে ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা । তাই হয়তো স্বপ্নে সেই আওয়াজ শুনেছে। টেবিল থেকে উঠে বই খাতা গুছিয়ে নিয়ে উঠে পড়ল খাটে। বাইরে বেশ ভালোই ঝোড়ো হাওয়া বইছে। ঘুমটা বেশ ভালোই হবে বলে মনে হচ্ছিল তনয়ার।
খট্ , খট্ , খট্ , খট্ । আবার সেই অদ্ভুত জানলায় টোকা মারার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল তনয়ার । হাওয়ার শব্দ? না, এ তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কেউ একজন টোকা মারছে জানলায় । তনয়ার সারা শরীর যেন হঠাৎ ভয়ে কেঁপে উঠল । হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল । এত ভয় তার কোনোদিন লাগেনি , কোনোদিন না।
খট্ , খট্ , খট্ , খট্ । না , আর পারল না তনয়া। সাহস জড়ো করে আস্তে আস্তে উঠল তনয়া। যেন প্রলয়ের রাজ্যে যাচ্ছে সে ! আওয়াজ ক্রমশঃ বাড়তে থাকল। তার মনে পড়ল আদুরে ছোটো বোন তিন্নির কথা, মায়ের কথা, বাবার কথা, তার প্রিয় দাদাভাই তরুণের কথা, প্রিয় বন্ধু রবিনের কথা । তনয়া কি কোনোদিন তাদের দেখতে পাবে আর ?
জানলার দিকে এগিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে হাত বাড়াল তনয়া, জানলার হাতলটা আস্তে আস্তে ধরল। ততক্ষণে তনয়ার হৃৎপিন্ড যেন হৃদয় থেকে বেরিয়ে এসেছে। সে বুঝতে পারল , হয়তো কোনো এক বীভৎস্য দৃশ্য তার অপেক্ষায় রয়েছে। না , আর দেরি করলে চলবে না। হাতলটা ধরে এক জোর টান দিল সে . . . . . . . . .
‘কে ? কে ওখানে ?’ বলে উঠল তনয়া। জানলা খোলা মাত্রই এক গুচ্ছ ঝোড়ো হাওয়া যেন তনয়ার ঘরের মধ্যে হুড়মুড় করে ঢুকে এল। কিন্তু কেউ কোত্থাও নেই। বাইরে ঘুট ঘুট করছে অন্ধকার। শুধু দূরের কোয়ার্টারগুলোর টিমটিমে বাতি জ্বলছে। না , কেউ কোত্থাও নেই। শুধু ঝোড়ো হাওয়া বইছে। সে আরেকবার হাঁক দিল। না , কেউ হতেই পারে না। কেউই নেই , হয়তো তার মনেরই ভুল , কোনো এক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু সে কি এতটাই ভুল ?
যাই হোক , তনয়া নিশ্চিন্ত হল। না , এবার ঘুমটা বেশ ভালোই হবে। জানলাটা ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিল সে। কিন্তু তনয়ার সেই নিশ্চিন্ততা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। পিছনে ফিরে আর্তনাদ করে উঠল তনয়া , চেঁচিয়ে উঠল , ‘না . . . . . . . . . . ’ |