Dipanti Ghatak, IX D (2019-20)
আমার লাদাখ ভ্রমণের বহুকালের প্রতীক্ষার আগুনে কেবল জ্বালানী যুক্ত করেছিল বলিউডের কিছু চলচ্চিত্র। এই মে মাসের প্রথম সপ্তাহে অবশেষে আমি লাদাখ ভ্রমণের সুযোগ পেলাম। এটি ছিল এমন একটি ভ্রমণ যা আমাকে সারাজীবনের স্মৃতি উপহার দিয়েছে ও আমার মনে বহু মায়াময় দৃশ্য খোদাই করে রেখে দিয়েছে।
বলা বাহুল্য যে লাদাখের উদ্দেশে যাওয়া রাস্তাটিরও নিজস্ব এক আবেদন রয়েছে। লাদাখ যাওয়ার পথে তুষারাবৃত এক খোলা আকাশ আমার চোখ পরিতৃপ্ত করে তুললো। নীচের দিকের নিস্তব্ধ, প্রশান্ত নীল হ্রদের দিকে চেয়ে আমি মুগ্ধতায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। লেহতে ঢোকার পথে ধূসর পর্বতবৃন্দ আমদের সকলকে অভিবাদন জানালো। লাদাখে স্বয়ং প্রকৃতির এই হস্তশীল্পের চেয়ে মূল্যবান মনোমুগধকর দৃশ্য পৃথিবীর অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
আমার মনের যুক্তিবোধ দাবী করেছিল যে লাদাখের এই অদ্ভুত আবহাওয়ায় প্রথম দিন অন্তত আমার বিশ্রাম নেওয়া উচিত। কিন্তু, আমার অদম্য কৌতূহল আমাকে এই জায়গাটিকে আরো ভালভাবে অন্বেষণ করার ইঙ্গিত করল। হোটেলে পরিবেশিত দুর্দান্ত থুকপা ওর সামপা আমাকে নিশ্চিত করে দিল যে এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হতে চলেছে একেবারেই অন্যরকম।
পরের দিন বেরিয়ে পড়লাম সো মোরিরির পথে। এই সময় আমি চিনতে পারলাম আসল লাদাখকে। চারিদিকে ছিল বহু উজ্জ্বল রঙের খেলা, এক অসমতল উপত্যকা, বরফে ঢাকা অন্তহীন পাহাড় ও তারই মাঝে আঁকা বাঁকা পথ দিয়ে আমরা ধেয়ে চললাম সো মোরিরির উদ্দেশ্যে। প্রথমবার, ঊষর ভূমির এমন অত্যুত্তম শোভা দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। পথে অনেক বৌদ্ধ বিহারও পড়েছিল, যেমন সে ও থিক্সে মনাস্ট্রি। সেখানে দেখতে পেলাম স্থানীয় লামাদের এক অন্যরকম জীবনধারা ও কিভাবে তারা তাদের বহু শতাব্দী পূর্ব কমনীয়তা এখনও বজায় রেখে দিয়েছে। ধূসর পাহাড়ের মাঝে দুর থেকে এই মনাষ্ট্রিগুলো দেখে বইতে পড়া নানা অতুলনীয় দৃশ্যের কথা মনে পড়ে গেল।
সো মোরিরিতে যখন পৌঁছলাম তখন বরফ পড়তে শুরু করেছে। জমে যাওয়া সো মোরিরি হ্রদের ধারে একটি হোটেলে উঠলাম আমরা। মুহূর্তের মধ্যেই চারিদিক বরফে ঢেকে একেবারে সাদা হয়ে গেল| যেই পরিবেশ পিঙ্গলবর্ণ ধারণ করেছিল সেটি নতুন করে শ্বেটবর্ণে সেজে উঠলো। সেইদিন গাড়িতে করে আশেপাশের জায়গাগুলির পর্যবেক্ষণ করতে গেলাম আমরা। সো কার হ্রদের কাছে গিয়ে মনে হল যেন আকাশ পাহাড় নদী সব মিশে এক হয়ে গেছে। সেখানে দর্শন পেলাম অতি অনন্যসাধারণ প্রাণী – হিমালয়ান রেড ফক্স। এই প্রাণীটি দেশ বিদেশের বহু পর্যটককে লাদাখের এক প্রান্তে অবস্থিত এই সো মোরিরি ও সো কার অঞ্চলে টেনে আনে। সেইদিন সো মোরিরি থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য আমার চোখকে পরিতৃপ্ত করে তুললো। সাদা বরফের উপর অস্তায়মান সূর্যের রাঙা আভা প্রতিফলিত হয়ে এক ময়াময় দৃশ্য সৃষ্টি করলো। সামনে হিমায়িত হ্রদের উপর দিয়ে পশমিনা গোট হেঁটে যাচ্ছিল। হোটেলের সামনে বসে এই স্বর্গীয় দৃশ্য দেখতে দেখতে আমি যেন সম্পূর্ণভাবে এক অন্য জগতে পৌঁছে গিয়েছিলাম।
আরো একটি দিন এই বিশ্রব্ধ স্থানটিতে কাটিয়ে আমরা রওনা হলাম পশ্চিম লাদাখে অবস্থিত উলে টোপোর পথে।এই স্থানটির আবেদন ছিল একেবারেই ভিন্ন ধাঁচের। একটি খোলা স্থানে বানানো তাঁবুর পাশ দিয়ে সিন্ধু নদী কুলুকুলু বইছে। তেমনি একটি তাঁবুতে দু রাত কাটালাম আমরা। এই জয়াগাতি থেকে সূর্যাস্তের আরেকরকম দৃশ্য পেলাম। সিন্ধুর ধারের ঊষর পর্বতবৃন্দের উপর সূর্যের আলো পড়লে মনে হলো যে সেইগুলি যেন স্বর্ননির্মিত। ধীরে ধীরে সূর্য নিস্তেজ হয়ে গেল। নদীর স্রোত বেড়ে গেল। এই ধূসর মরুভূমিকে গ্রাস করল নিস্তব্ধতা। সারারাত কানে শুধুই পৌঁছলো বহমান সিন্ধুর ধ্বনি।
আমাদের আগামী গন্তব্যস্থান ছিল পাকিস্তানের বেলুচিস্তান বর্ডারের কাছে অবস্থিত একটি স্থান – তূর্তুক। লাদাখের মরুভূমির মাঝেও যে এমন শস্য শ্যামলা স্থান থাকতে পারে তা হয়তো আমি কোনদিনই জানতে পারতাম না এই জায়গাটিতে না এলে। ভারত পাকিস্তান বর্ডারের একদম নিকটে অবস্থিত হাওয়ায় এখান থেকে ভারত ও পাকিস্তান, দুই দেশেরই আলাদা আলাদা পাহাড়, বাংকার ও সেনাবাহিনীদের দেখতে পাওয়া যায় এখান থেকে। এখনকার স্থানীয় মানুষদের মধ্যের তীব্র দেশাত্মবোধ দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ভারতের অন্য কোথাও লোকেদের মধ্যে এমন প্রখর দেশাত্মবোধ আমি আগে কখনো দেখিনি। একজন স্থানীয় লোক নিজে থেকেই এসে পরমোৎসাহে আমদের তাদের ছোট্ট তূরতুক গ্রামটি ঘুরিয়ে দেখালো। সে নিজের বাড়িতে আমাদের নিয়ে গিয়ে দেখালো কর্গিলের যুদ্ধের সময় কোথায় তার বাড়িতে বোম পড়েছিল। এইসব দেখে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। মনে হলো আমি যেনো এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর গল্পের অংশ হয়ে উঠেছি নিমেষের মধ্যে।
আমাদের অন্তিম উদ্দেশ্য এবং আরো এক মায়াময় জায়গা ছিল প্যাঙ্গং সো লেক। এই স্থানটি সারাদিন ধরে রঙের খেলা দেখিয়ে আমাকে সম্মোহিত করে তুললো। কখনো সূর্যোদয়ের সময় আকাশী রঙের গৌরব, কখনো সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় সোনালী আভা, আবার কখনো সূর্যোদয়ের সময় গাঢ় নীল, সব মিলিয়ে সারাদিন প্রায় সাত আট রকম রঙের ছটা দেখালো এই প্যাঙ্গং সো।
এই মনোরম স্থানটিতে দুদিন কাটিয়ে আমরা লেহ শহরে ফিরে এলাম।
পরের দিন প্লেনে করে কলকাতার জন্য রওনা হয়ে পড়তে হল। এইসময় একটাই কথা মনে পড়লো, ‘যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই
যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই’।