Upolobdhi Karmakar, IX E (2019-20)
ক্লাসরুম পড়ার ডুবে আছে। চলছে মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ। শেষ বেঞ্চে ঋক আর সায়ন্তিকা চাপা খুঁনসুটিতে ব্যস্ত। আর অন্যদিকের কোনে শিক্ষিকার একটিও কথা “মিস” করতে রাজি নয় অহনা।
যদিও সে এই ক্লাসে পিছিয়ে পড়ার দলে, তবু চেষ্টার দিক থেকে কখনো তার ত্রুতি থাকে না। শ্রুতিও মনযোগী শ্রোতা, তবে তার ব্যাপারটা আলাদা, ক্লাস এইটের ‘ফাস্ট গার্ল’ বলে কথা ।
ডিসেম্বর মাসের একেবারে গোড়ার দিক, শীতের ছুটি পড়ল বলে। তার আগে সবাই ব্যস্ত বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতিতে, কারও দম ফেলার ফুরসত নেই। এরই মধ্যে বাংলা দিদিমনি শ্রুতিসহ ক্লাসের আরো কয়েকজনকে ডেকে একটি ছোট গল্প লেখার কথা বললেন, বিষয়- ‘বন্ধু তোমার জন্য’।
সবাই এক বাক্যে রাজি। সারা বাংলা প্রতিযোগিতা, সেখানে গল্প লেখার সুযোগ পাওয়াটাই তো বিশাল ব্যাপার। তাই নির্বাচিত ছাত্র-ছাত্রীদেরকে জনাকয়েকের হাভভাবে সেই গর্বটা বেশ প্রকাশও পেতে লাগলো।
পাশাপাশি চলছে একের পর এক পরীক্ষা, নাওয়া খাওয়া ভুলে সবার মতোই শ্রুতিও ডুবে গেল পঠন-পাঠনে। আর তারই মাঝে একেবারে ভুলেই গেল প্রতিযোগিতার কথা।
ইতিমধ্যে গল্প জমা দেওয়ার শেষ দিন উপস্থিত। আগের রাতে ঘুমনোর সময় বই গোছাতে গিয়ে শ্রুতির মনে পড়ল সেই কথা। মাথাটা যেন এক ঝটকায় শূন্য হয়ে গেল তার। কোনোমতে কাগজ কলম নিয়ে বসল সে।
কিন্তু আনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই একটা গল্প ঠিক বুনে উঠতে পারল না মেয়েটা। অন্যরা কি করছে জানার জন্য বন্ধুদের ফোন করল একে একে।কিন্তু কেউই তেমন ভাবে তাকে সাহায্য করার আগ্রহ দেখালো না শেষ মুহূর্তে।তার ওপর পরদিন রয়েছে শেষ দুটি পরীক্ষা- ইতিহাস আর অংক। শ্রুতির পড়া অবশ্যই তৈরি, কিন্তু গল্পটা?
বাইরের আকাশ তখন শীতের কবলে, রাতের কালো চাদর মুড়ি দিয়েছে আপাদমস্তক। চারিদিকটা কেমন গুমোট। সবকিছু যেন থমকে গেছে হঠাৎ।
এদিকে শ্রুতির স্টাডিটেবিল ঘড়িতার কাটা নিরলস। এগিয়ে চলেছে রাত 11 টার দিকে।গতা ঘরে, বাড়িতে মেখে রয়েছে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। টেবিলের সামনে জানালার বাইরে অপলক দৃষ্টি শ্রুতির। সেই দৃষ্টি যেন কাতরভাবে রাতের আকাশ থেকে খুঁজে নিতে চাইছে তারার গাঁথা কিছু শব্দ।
ষদিনের পরীক্ষার আগে, একটা গোটা রাত শ্রুতি প্রায় এক লহমাই কাটিয়ে দিল একটা গল্প বোনার আশায়। দু চোখের পাতা থেকে ঘুম যেন কে কেড়ে নিয়েছে তার। স্টাডিটেবিলে বসা শ্রুতির কলম তখনও তখনো হাতরাচ্ছিল গল্প। রাত এর শিশিরের সঙ্গে গাছের পাতায় ছুইয়ে পড়েছে নিভে আসা বাঁকা চাঁদ। এবার ভোর হল বলে। বিছানার বদলে আজ টেবিল ছাড়ল শ্রুতি। রোজকার মতোই তৈরি হয়ে গনেশকাকুর পুলকারে উঠল যথাসময়ে। স্কুলে পৌঁছে চুপচাপ, বেছে নিল শেষ বেঞ্চের জানালার ধারটা। এত চেষ্টা করেও রাতভর একটিও বর্ণ লিকতে পারেনি সে। শুধু এটাই মনে হছিল বারবার, যেন নিজের কাছেই হেরে গেছে শ্রুতি।
দেখতে দেখতে ব্রেকর ঘণ্টা পড়ল। প্রথম পর্বে ইতিহাস ছিল। ব্রেকর ওপারে হবে অঙ্ক। মুহুর্তের মধ্যে ক্লাস ঘর খালি। মাছের এক ঘন্টা সকলেই কমবেশি উত্তর মেলাতে আর পরের পরীক্ষার প্রস্থুতি নিতে করিডরে বেরিয়ে গেছে। ক্লাসের এক কোনে বসে রয়েছে শ্রুতি।একা। কি আশ্চর্য আর তার কাছের বন্ধুরা বিশেষত যাদের কাল ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল সে, তেমনটা কাছে ঘেঁষলও না তার। পাছে আবার কোন সহযোগিতা চায় সে – তাই কি? একুশ শতকের বন্ধুত্বটি তবে প্রতিযোগিতার আসলে এতটাই ঠুনকো?
এমন সময় কে যেন এসে বসলো তার পাশে। অহনা! বাড়িতে তখন গুমোট আকাশে গরবিনী মেঘের দল ভেঙে পড়তে উদ্দত। আর সেই এক আকাশের নিচে তখন দুটি মানুষ পাশাপাশি একে অপরের কাছে নিজেদের মেলে ধরার অপেক্ষায়। খানিকবাদে নিজেদের যাবতীয় যন্ত্রণা কে বিশ্বাস করে আকাশ থেকে নেমে এলো অকাল মেঘের দল – ঈশ্বর কণা! আর প্রায় একই সঙ্গে শ্রুতির কলমে প্রসব করল তার গল্পের প্রথম শব্দবন্ধ –‘ওলো সই’ ! এরপর গল্পটা শেষ করতে আর দশ মিনিটের বেশী লাগল না।
একমাস পর
সভাগৃহে তখন তীব্র উত্তেজনা শিক্ষক-শিক্ষিকা অভিভাবক ও ছাত্র-ছাত্রীদের কানায় কানায় ঠাসা। মাইকে ভেসে এলো ঘসিকার সুমধুর কণ্ঠস্বর “এবার আপনাদের সামনে প্রকাশ করবার পালা সেই নামগুলি যারা ‘ভারতীয় সাহিত্যগোষ্ঠী’ আয়োজিত এই সারাবাংলা গল্প লেখা প্রতিযোগিতার প্রথম স্থান দখল করে নিয়েছে। তাহলে আর দেরি না করে শুরু করা যাক প্রতিযোগিতার তৃতীয় স্থান অধিকারী হলেন”…। দর্শক আসনে বসা শ্রুতির কেমন একটা অদ্ভুত অনুভুতি হল এমনটা এর আগে কখনো হয়নি তাই যে কোন প্রতিযোগিতার ফল ঘোষণার সময় চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসী থাকে সে কিন্তু আজ শ্রুতির যেন একেবারে পরাজিত হলো মনে হলো নিজেকে। ভাবনার জাল ছিঁড়ে আবার শোনা গেল ঘসিকার কণ্ঠস্বর। “আমাদের দ্বিতীয় স্থান অধিকারী হলেন…” হাততালির শব্দে অনুরণিত পরিপূর্ণ সভাঘর কিন্তু শেষ সারিতে বসা শ্রুতির বুকে একটা দলা পাকানো কষ্ট। মনে হচ্ছিল, সবাই যেন তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। পরিহাস করছে তাকে। সে আজ আর সেরা থাকতে পারল না। শ্রুতি কান চাপা দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল। নিজের কানে নিজের হারের কথা কিছুতেই শুনবেনা সে। ঘসিকা আবার মাইকে। এবার এল সেরার সেরা প্রতিযোগীর নাম –“শ্রুতি হালদার সেন্ট জনস হাই স্কুল”। নিজের নামের সঙ্গে একটা ক্ষীন শব্দ শুনতে পেল সে-“ শ্রুতি তুই জিতে গেছিস”।
বুঝতে পারল না এটা সত্যি কিনা। আশে পাশে বসা সহপাঠী ও শিক্ষিকাদের অভিবাদনের বন্যায় ক্রমশ সম্বিত ফিরে পেল সে। গুটি গুটি পায়ে হেঁটে গিয়ে উঠল স্টেজে। পুরস্কার নেওয়ার পর উদ্যোক্তারা তাকে কিছু বলার অনুরোধ করলেন। কাপা হাতের মুঠোতে মাইকটা নিল শ্রুতি।
“নমস্কার।
আমি অহনার বন্ধু, শ্রুতি গতবছর অব্দি অহনা আমার সহপাঠী ছিল। এই বছর বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারেনি বলে আমাদের স্কুল থেকে চলে যেতে হয়েছে অকে। গত আট বছর আমরা একসঙ্গে পড়েছি কিন্তু কখনো সেভাবে কথা বলা হয়ে ওঠেনি। আমি ফার্স্ট গার্ল আর ও টেনেটুনে পাশের দলে। আসলে নম্বরটাই আমাদের মধ্যেকার দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছিল সম্ভবত। আমরা যেদিন প্রথম বন্ধু হলাম সেই দিনই এই গল্পের জন্ম।
জানেন, পরীক্ষার চাপে আমি গল্প লেখার কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম। গল্প জমা দেওয়ার শেষ দিনে ক্লাসরুমের এক কোণে আমি যখন হেরে বসে আছি, তখনই অহনা এসেছিল আমার কাছে। এই প্রথমবার আমি না পারার দুঃখ কে ভাগ করে নিয়েছিল কেউ বলেছিল-“ আমি তো সবকিছুতেই হারিরে, তবু দেখ আবার চেষ্টা করে উঠে দাড়াই। তুইও একবারটি চেষ্টা কর বন্ধু, দেখবি তুই জিতে গেছিস। এইবার পাস না করতে পারলে আমি হয়তো আর এই স্কুলে থাকতে পারবো না, তোর সঙ্গে দেখা হবে না হয়তো কখনো। কিন্তু তুই জেনে রাখিস, আমি জীবনে হারব না। আর তুই ও হেরে যাস না বন্ধু”।
অহনা চলে গেছে স্কুল থেকে। কিন্তু যাওয়ার আগে আমাকে দিয়ে গেছে ওই দিন, ওই মুহূর্তের ঘটনা গুলিকে তৎক্ষণাৎ বসে এই গল্পের শরীর দেওয়ার প্রেরনা। আর সেই সঙ্গে বুঝিয়ে গেছে আরও একটি মূল্যবান কথা। আমাদের এই ছাত্র জীবনে নম্বরটায় শেষ কথা নয়। পড়াশুনার এই দৌড় এর বাইরেও আছে গানে-গল্পে ভালোবাসায় বন্ধুত্ব ভরা আকাশ যেখানে আছেন আমাদের বাবা মায়েরা শুভানুধ্যায়ীরা –যারা শেষ অবধি আমাদের হারতে দেবেন না।
ওলো সই, আর তুই যেখানেই থাকিস ভালো থাক। আমার বিশ্বাস জীবন যখন পরীক্ষা নেবে তখন তুই-ই ফাস্ট হবি। আর জেনে রাখিস তোর এই বন্ধুও কখনো হারবে না”।