Supurna Mukhopadhyay, VIII A (2019-20)
রাত তখন একটা-দুটো হবে। বাড়ির সকলে অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু আমিই জেগে আছি।বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। তাই ধরাবাঁধা জীবনের ঘেরাটোপের বাইরে বেরোনোর সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমি বইমেলায় কেনা “পঞ্চাশটি ভূতের গল্প” পড়ছি। ভূত আমি বিশ্বাস করি না, তবুও এ রকম নিঝুম রাতে গা ছমছমে ভূতের গল্প পড়ার মজাই আলাদা৷যদিও গল্পে আমরা গ্রাম-গঞ্জের ভূতের কথা অনেক শুনি, শহরের ভূতের কথাও কম শুনিনি। “ভূতের ভবিষ্যৎ” চলচ্চিত্রটিই তো খোদ কলকাতা শহরের ভূতেদের কাহিনি ।
সেদিন সন্ধ্যা থেকেই বাইরেটা গুমোট হয়ে ছিল। আমার ঘরের জানলার বাইরের সুপুরি গাছের পাতাগুলিও নড়ছিল না৷ স্থির হয়ে থাকা পাতাগুলি যেন গা ছমছমে ভাবটা বাড়িয়ে তুলছিল। বাইরে কোন আলোই ছিল না। কোন কারণে সারা সন্ধ্যাই বাড়ির সামনের রাস্তার আলো জ্বলছিল না। আকাশটাও একেবারে কালো হয়ে ছিল। হঠাৎ একটু একটু হাওয়া শুরু হল।
আর তখনই সেই নিঝুম রাতে গভীর ঘুমে ডুবে থাকা পাড়ার নিস্তব্ধতার মধ্যে কার যেন মেঝেতে পা ঘষে ঘষে হাঁটার শব্দ স্পষ্ট কানে এল।চমকে উঠে কিছুক্ষণ কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলাম। কোনো ভুল নেই, জানলার দিক থেকে আসা এই শব্দ আমার খুব চেনা। আমাদের সামনের বাড়ির রমাদিদার। আমাদের জানলার মুখোমুখিই তাঁর ঘর।পায়ে সমস্যার জন্য বিশেষ ধরণের জুতো পরে ঘরের মধ্যে পা টেনে চলেন। এই রে! এমনিতেই দিদা খিটখিটে স্বভাবের, তার উপর বোধহয় আমার ঘরের আলো জানলা দিয়ে দিদার ঘরে ঢুকছে, তাই তিনি ঘুমোতে পারছেন না। আগেও এ রকম হয়েছে, আমি একটু জোরে টিভি বা গান চালালে দিদা রাগারাগি করেন। এই রাতেই আবার বকাবকি না শুরু করেন, এই ভেবে আমি জানলার পর্দাটা টানবার জন্য খাট থেকে নামলাম৷
মাটিতে পা দিতেই আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। আমার পা দুটি যেন মাটির সঙ্গে কে গেঁথে দিয়েছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল কয়েকদিন আগের এরকমই এক রাতের কথা। সে রাতে রমাদিদার ছেলে রঞ্জনকাকু হঠাৎ এসে বাবাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পরে বাবা ফিরে জানালেন যে রমাদিদা হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তা হলে ? এই পায়ের শব্দ কোথা থেকে আসছে? কোন রকমে সমস্ত শক্তি ও সাহস জড়ো করে পাশের যে ঘরে বাবা-মা ঘুমোচ্ছন, সেই ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। হঠাৎ নজর পড়ল জানলার পাশে নতুন কেনা চেয়ারের আধছেঁড়া প্লাস্টিকের আ্স্তরণের দিকে। যখনই জানলার পর্দা উড়ে এসে প্লাস্টিকে ঘষা লাগছে, তখনই শব্দ হচ্ছে, অবিকল রমাদিদার পায়ের শব্দ!
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। নিজের বোকামিতে নিজেরই হাসি পেতে লাগল। ঘুমোতে যাবার আগে যে গল্পটা পড়ছিলাম, সেটা শেষ করার জন্য বইটা তুলে নিলাম। কিন্তু পুরো গল্পটাই কেমন যেন ছেলেমানুষি মনে হতে লাগল। বই বন্ধ করে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।